প্রেরণার ১১ই মে : বদর দিবস, কুরআন দিবস এবং আমীরে জামায়াতের শাহাদাত দিবস

আজ ১১ই মে ২০২০। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে বিভিন্ন দিক থেকে আজকের দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনটি আমাদের জন্য প্রেরণার, সাহসের, উদ্দীপনার। দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান অনুসরণে আজ বদর দিবস। ১৯৮৫ সালের ১১ই মে অনুসরণে আজ ঐতিহাসিক কুরআন দিবস। ২০১৬ সালের ১১ই মে স্মরণে আজ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রহ.-এর শাহাদাত দিবস। তিনটি ঘটনার মধ্যেই সত্য মিথ্যার লড়াই রয়েছে, তিনটি ঘটনার মধ্যেই শাহাদাত রয়েছে, তিনটি ঘটনার মধ্যেই বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম রয়েছে, তিনটি ঘটনার মধ্যেই বাতিলের কাছে মাথা নত না করার ইতিহাস রয়েছে, তিনটি ঘটনার মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়ে যাওয়া রয়েছে।

১৯৮৫ সালের ১১ই মে- ঐতিহাসিক কুরআন দিবস :
কুরআনের দুইটি আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে দুইজন উগ্র হিন্দুর দায়ের করা মামলা ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল কোলকাতার হাইকোর্ট আমলে নেয় এবং বিচারপতি পদ্ম খাস্তাগির রিট গ্রহণ করে ৩ সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট দাখিল করার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ প্রদান করেন। এ গর্হিত ঘটনায় সারাবিশ্বের ন্যায় পরদিন ১১ এপ্রিল ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেইটে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ সমাবেশে আগত ইসলামপ্রিয় জনতাকে বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয়, অনেককে নির্মমভাবে আঘাত করে আহত করে, অনেককে গ্রেফতার করে। তারা জানে না, কুরআনপ্রেমী মানুষকে নির্যাতন করে, সমাবেশ ভন্ডুল করে থামানো যাবে না। সরকারের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে মাসব্যাপী ঘোষণা করা হয় লাগাতার বিক্ষোভ কর্মসূচি। পাড়া-মহল্লায়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় গড়ে ওঠে তুমুল আন্দোলন।

তারই ধারাবাহিকতায় ১১ই মে চাঁপাইবাবগঞ্জের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে আয়োজন করা হয়েছিল প্রতিবাদ সমাবেশের। সমাবেশ পণ্ড করতে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা নির্দেশ দিলেন গুলি চালানোর। বিনা উস্কানিতে এক নাগাড়ে গুলি চললো পনের মিনিট। পুলিশের গুলিতে একে একে শহীদ হন কৃষক আলতাফুর রহমান, রেল শ্রমিক নজরুল ইসলাম, রিক্সা চালক মুক্তার হোসেন, শাহাবুদ্দিন, দিন মজুর সেলিমউদ্দিন, শিবিরের স্কুল কর্মী শীষ মোহাম্মদ, আব্দুল মতিন, রাশেদুল হক। আহত হয় শতাধিক মুসলিম জনতা। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঘটে যাওয়া সেদিনকার নির্মম নারকীয় হত্যাকাণ্ড ছিল হৃদয়বিদারক। এতো শহীদ, আহতের ঘটনা যাতে বাংলাদেশের মানুষ না জানতে পারে তাই পরদিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশে সরকারের পক্ষ থেকে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।

বিশ্ব-মুসলিমের প্রতিবাদের মুখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মামলাটি খারিজের জন্য এটর্নি জেনারেলকে নির্দেশনা দেয়। ১৩ই মে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি. বসাকের আদালতে স্থানান্তরিত হলে মামলাটি তিনি খারিজ করে দেন।

তখন থেকেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ১১ই মে-কে ঐতিহাসিক কুরআন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কুরআনপ্রেমী জনতার কুরআনের প্রতি ভালোবাসার উজ্জল দৃষ্টান্ত তৌহিদী জনতার মাঝে জাগরুক করে রাখতেই এই দিবস পালন করা হয়।

বিশ্লেষণ :
o কুরআনের অবমাননার প্রতিবাদে, কুরআনের মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন সকল শ্রেণি পেশার তৌহীদি জনতা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন অকুতোভয় সৈনিকের ন্যায়।
o এদেশের মানুষেরা মনেপ্রাণে ইসলামকে ভালোবাসে, জীবন দিয়ে হলেও কুরআনের অবমাননা ঠেকাতে জানে তাঁরা।
o এ ঘটনা প্রমাণ করেছে, এদেশের মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা বিদ্যমান। সে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ ও হক্ব কী, মানুষকে সেটাই বোঝাতে হবে মমত্ববোধ সহকারে। তাহলে, তারা প্রকৃত অর্থে কুরআনের আইন বলবৎ না থাকায় যে অন্যায় হচ্ছে, কুরআনের অমর্যাদা হচ্ছে, তা বুঝতে পারবেন এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য দাবী তুলবেন তীব্রভাবে, ইনশা-আল্লাহ।

১১ মে ২০১৬ - শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রহ.-এর শাহাদাত দিবস :
ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াতে ইসলামী আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় রত। ইসলামের শত্রুদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি আমরা। কুরআনের শত্রুরাও থেমে নেই। আমরাও থামতে শিখিনি। সত্যিকার অর্থে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য বাস্তবভিত্তিক এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হওয়ায় বাতিল শক্তি তাই আমাদেরকে টার্গেট করে হত্যা, নির্যাতন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ায় শহীদ করা হয়েছে জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে। শহীদ করা হয়েছে, আমীরে জামায়াত, সেক্রেটারী জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেলবৃন্দসহ নেতৃবৃন্দকে, আটক করে রাখা হয়েছে অনেককে।

১১ মে ২০১৬ তে শহীদ আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীকে ন্যায়ভ্রষ্ট বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়। শাহাদাতের আগে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারের সদস্যদেরকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। যেসব এলাকার ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে সেসব এলাকায় ১৯৮৬ সালের আগে আমি কখনো যাইনি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঐ এলাকায় আমি প্রথম যাই।” তিনি আরও বলেন, “অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। হত্যা করে ইসলামী আন্দোলনকে নির্মূল করা যায় না। শহীদি রক্ত ইসলামী আন্দোলনকে আরও মজবুত করে। আল্লাহ যদি আমাকে শহীদি মৃত্যু দেন তাহলে আমার রক্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন আরও মজবুত ও বেগবান হবে ইনশাআল্লাহ। আমার শাহাদাত বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। এ সরকার আমার ওপর জুলুম করেছে। সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট অবশ্যই আমি ন্যায়বিচার পাবো।”

প্রেরণা : প্রকৃতপক্ষে ইসলামী আন্দোলন করাই ছিল তাঁর অপরাধ! যারা অন্যায়ভাবে নিপীড়ন চালিয়েছে তাদের বিচার দুনিয়াতেও হতে পারে, আর আখেরাতে তো হবেই, ইনশা-আল্লাহ। ওরা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে হত্যা করতে পারলেই মনে করে সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সূরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াত অনুযায়ী আমরা জানি, শহীদরা মরে না বরং তাঁরা জীবিত, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনা। ইসলামী আন্দোলনের পথে চলতে গেলে নানান রকমের পরীক্ষা আসবে। ধৈর্যের সাথে তা পার করতে হবে, এটাই কুরআনের শিক্ষা। মাওলানা নিজামী সে ধৈর্যেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর সহকর্মী শহীদ নেতৃবৃন্দও একইভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। আমাদের নিকট আখিরাতের সাফল্যই আসল। আমরা অকপটে গেয়ে যাই, “আমাকে দাও সে ঈমান, আল্লাহ মেহেরবান। যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে অসংকোচে গায় জীবনের গান।”

২য় হিজরীর ১৭ রমজান-ঐতিহাসিক বদর দিবস :
দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান মদিনা হতে ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে মক্কার মুশরিক বাহিনীর সাথে মুসলমানদের বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অসম সেই যুদ্ধে এক হাজার মুশরিক সৈন্যের বিরুদ্ধে ৩১৩ জনের মুসলিম বাহিনী আল্লাহর রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। জাগতিক শক্তি মুসলমানদের কম ছিল। কিন্তু ঈমানী বলে তাঁরা ছিলেন বলিয়ান। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর নির্দেশ মেনে চলার মধ্যেই তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের স্বার্থকতা, সফলতা। তাইতো আল্লাহর ওপর ভরসা করে বাতিলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেছিলেন এবং মুসলমানরা বিজয় অর্জন করেছিলেন।

তিনটি ঘটনা থেকেই আমরা দেখি, আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস প্রেরণার ইতিহাস। তাঁরা বাতিলের কাছে মাথা নত করেনি। আল্লাহর দ্বীনের ওপর অটল অবিচল থেকেছেন। প্রয়োজনে নিজেদের জীবন আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছেন। তবুও আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় থেকেছেন দৃঢ়। আর সে দৃঢ়তা, সে কুরবানীর সাক্ষ্যই উপস্থাপনা করে রেখে গিয়েছেন আমাদের মাঝে। সে সাক্ষ্য আমাদেরকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে আগামীর পানে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আজকের সময়েও যদি আমরা দ্বীনের পথে অটল অবিচলতার সাথে অগ্রসর হই, বাতিল আমাদের পথ রুধতে পারবে না; আমরা ইসলামের ঝান্ডাকে উচ্চকিত করতে এগিয়ে যেতে পারবো ইনশা-আল্লাহ।

মন্তব্য