আমরা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলামী আন্দোলনের হক আদায় করার জন্য ইসলামী সংগঠনভুক্ত হয়েছি। আমরা সংগঠনের সাথে মিলেমিশে, সংগঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত ফরজ ইবাদত-জিহাদের দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টা চালাই। সংগঠনের সাথে মিলে কাজ করতে গিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে নানাবিধ দায়িত্ব আমাদের উপরে দেয়া হয়। সেসব দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা চেষ্টা করি মূলত দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের রব আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করতে চাই বলে। আর আল্লাহ খুশি হলে পুরস্কারস্বরূপ তিনি আমাদেরকে পরকালে জান্নাত দেবেন। অতএব আমাদের এক্ষেত্রে জান্নাতপ্রাপ্তি মুখ্য একটি চাওয়া। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জান্নাত পাওয়ার জন্য থানা সভাপতি হওয়ার কোনো শর্ত নেই, ওয়ার্ড সভাপতি হওয়ার কোন জরুরিয়ত নেই, উপশাখা বা কেন্দ্রের দায়িত্বশীল হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; বরং একজন সাধারণ কর্মীও যদি খুলুসিয়াতের সাথে সর্বোচ্চ আন্তরিকতাসহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে এবং আল্লাহ তায়ালা তার সে প্রচেষ্টা কবুল করে তাকে জান্নাতে ঠাঁই দেন, তাহলে সেটাই তার সফলতার কারণ হবে। অপরপক্ষে দায়িত্ব যত বড় হয়, আল্লাহর কাছে জবাবদিহির কাঠগড়া ও পরিসর তত বড় হয়। আমাদের মধ্যে শঙ্কা আর ভয় বাড়ে যে, আমরা এই দায়িত্বের পরিসরের আলোকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে পারবো কিনা! আবার এটাও সত্য যে, ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকেই মঞ্জুর হয়। এ দায়িত্ব যেমনিভাবে চেয়ে নেয়ার সুযোগ নেই, একইভাবে এই দায়িত্ব আমাদের কারও উপর এলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ারও কোন অনুমতি নেই। বরং দায়িত্ব চলে এলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে চেয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে আমরা বাধ্য। শঙ্কার দিকের পাশাপাশি আরেকটি আশার দিক এখানে রয়েছে। সেটা হচ্ছে- হতেও পারে, আরোপিত দায়িত্ব খুলুসিয়াতের সাথে পালনের প্রচেষ্টা দেখে আমাদের রব আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি খুশি হয়ে যাবেন এবং মেহেরবানি করে আমাদেরকে মাগফিরাত দান করবেন। হতেও পারে- এ দায়িত্ব পালন পরকালে নাজাতের জন্য সহায়ক হবে, এ দায়িত্বই পরকালে নাজাতের ওসিলায় পরিণত হতে পারে। অতএব শঙ্কা-ভয় ও আশা-প্রত্যাশা এ উভয় দিককে একসাথে ধারণ করে আমাদেরকে আমাদের উপর চলে আসা দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য।
আমরা ইসলামী আন্দোলন করি মৌলিক দুইটি পুরস্কারের জন্য। সূরা আস সফের ৯-১৩ নম্বর আয়াত খেয়াল করলে আমরা সে পুরস্কারের কথা জানতে পারি। প্রথম ও মুখ্য পুরস্কার হচ্ছে জাহান্নাম থেকে বাঁচা, আল্লাহর মাগফিরাত পাওয়া ও জান্নাতে যাওয়া। যেটাকে এক কথায় বলা যায় ব্যক্তির পরকালীন মুক্তি তথা জান্নাতপ্রাপ্তি, যেটাকে আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বড় পুরস্কার হিসেবে গণ্য করেছেন। আর দ্বিতীয় পুরস্কার হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্যের মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়। এই দুই পুরস্কারের জন্যই আমরা ইসলামী আন্দোলন করি। তবে অবশ্যই দ্বিতীয় পুরস্কারের জন্য আমরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাই, মূলত তার মধ্য দিয়ে আল্লাহকে খুশি করে তাঁর নিকট থেকে পুরস্কারস্বরূপ জান্নাত প্রাপ্তির জন্য। তাই ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রচেষ্টা আমাদেরকে সেই পথেই চালাতে হয়, যে পথের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন ও রাসূলুল্লাহ (সা.) সে অনুসারে প্রচেষ্টা চালিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন।
আমরা বিপ্লবের জন্য কাজ করছি। একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমাদের হৃদয়ের মধ্যে স্বপ্ন এঁকে নিয়েছি। সংগঠন ইসলামী বিপ্লব তথা ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে সে প্রত্যাশিত বিপ্লবে আমাদের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ কতটুকু হবে? সেটা বুঝার জন্য একটি যুদ্ধের ময়দানের উদাহরণ দিতে চাই। একজন সেনাপতি যুদ্ধে বিজয়ের জন্য যুদ্ধের ময়দানে নানানভাবে সৈন্যবাহিনীকে সাজান। কিছু সৈন্যকে তিনি সম্মুখ সমরের জন্য নিয়োজিত করেন, কিছু সৈন্যকে তীরন্দাজ বাহিনীর অংশ হিসেবে নিয়োজিত করেন, কিছু সৈন্যকে অশ্বারোহী বাহিনীর অংশ হিসেবে নিযুক্ত করেন, কিছু সৈন্যকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অংশ হিসেবে নিযুক্ত করেন, কিছু সৈন্যকে তিনি গিরিপথে দাঁড় করে দেন যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে যেন তারা না নড়ে যায়, আবার কিছু সৈন্যকে তিনি রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখে দেন যে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত যেন তারা সেখান থেকে না সরে যান। এখন যাদেরকে যেখানে দায়িত্ব দেয়া হলো তারা যদি সেই নির্দেশনার আলোকে নিজ নিজ জায়গাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন তাহলে তাদের সবার দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টার যোগফল হিসেবে সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়; কিন্তু অপরপক্ষে যাদেরকে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যদি নিজ নিজ জায়গায় দায়িত্ব পালন না করে তাদের স্থান পরিবর্তন করে ফেলে, যেমন যাদেরকে গিরিপথে দাঁড় করে দেয়া হয়েছে তারা যদি নির্দেশনা বা অনুমতি ছাড়াই সম্মুখ সমরে এসে যুদ্ধ শুরু করে দেন অথবা যাদেরকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে তারা যদি নির্দেশনা বা অনুমতি ছাড়াই সম্মুখ সমরে এসে যুদ্ধ শুরু করে দেন তাহলে হয়ত সংঘর্ষ অনেক বেশি হবে, দেখে মনে হবে আমরা বোধ হয় প্রচণ্ড আকারে যুদ্ধ করতে পারছি কিন্তু সেই যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। এই উদাহরণ থেকে যে শিক্ষা নিতে চাই সেটি হচ্ছে গোটা বিপ্লবের জন্য সংগঠন পরিকল্পিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের কর্মী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যেখানেই আমাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হোক না কেন, সেটা উপশাখায় হোক অথবা কেন্দ্রেই হোক, সেখানে নিজেকে ইসলামের ওপর অটল অবিচল রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জায়গাটিতে সংগঠনের নির্দেশনার আলোকে, সংগঠনের পরিকল্পনার আলোকে সে জায়গাটিকে পরিচালনা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো এবং অন্যান্য জায়গার জন্য দোয়া করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার সুযোগ থাকলে তা করা।
আমাদের গোটা দেশের যেই জনশক্তি আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা পেয়েছি সবাই মিলে আমাদের কাজ হচ্ছে গোটা সংগঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। সবাইকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর স্বার্থে সংগঠনকে বিভিন্ন স্তরে সাজানো হয়েছে। যেমন কেন্দ্র, শাখা, থানা, ওয়ার্ড, উপশাখা। কয়েকটি উপশাখাকে দেখভাল করার জন্য ওয়ার্ড, কয়েকটি ওয়ার্ড বা ইউনিয়নকে দেখভাল করার জন্য থানা, কয়েকটি থানাকে দেখভাল করার জন্য শাখা, শাখাগুলোকে সরাসরি দেখভাল করে কেন্দ্র। কেন্দ্রের নির্দেশনা অঞ্চল তত্ত্বাবধায়ক, শাখা, থানা, ওয়ার্ডের মধ্য দিয়ে সংগঠনের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সহজেই পৌঁছে দেয়া সম্ভব আবার সংগঠনের প্রান্তিক পর্যায়ে থেকে তাদের কথা সহজেই কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে পৌঁছানো সম্ভব। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সকল জনশক্তিকে যথার্থভাবে কাজে লাগানোর এই কৌশলের নামই হচ্ছে সাংগঠনিক কাঠামো। সংগঠনের প্রত্যেকটি স্তর যদি যথাযথভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলেই তাদের সবার কাজের যোগফল হিসেবে কেন্দ্রীয় সংগঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতে পারে ইনশাআল্লাহ।
সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সংগঠনের বিভিন্ন স্তরকে একই সূত্রে গেঁথে কাজে লাগানোর কী প্রক্রিয়া হতে পারে সেটাই এ পর্যায়ে বর্ণনা করার জন্য চেষ্টা করছি।
প্রয়োজনীয় ধাপসমূহ
♦ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা
♦ পরিকল্পনা অধস্তন শাখাগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া। (যেমন: কেন্দ্রে যদি পরিকল্পনা নেওয়া হয় যে, এ বছর যেসব কলেজে সংগঠন নেই, সেগুলোর মধ্য থেকে ১০% কলেজে সংগঠন বৃদ্ধি করা হবে অর্থাৎ ন্যূনতম উপশাখা বৃদ্ধি করা হবে। সেক্ষেত্রে শাখায় উক্ত পরিকল্পনা ১০% আকারেই যাবে। ধরি একটি শাখায় ১০০টি কলেজের মধ্যে ৫০টিতে সংগঠন আছে। তাহলে মোট ৫০টিতে নেই। এখন এই ৫০ এর ১০% অর্থাৎ ৫টি কলেজে সংগঠন বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করবে উক্ত শাখা।)
♦ বণ্টিত পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া
♦ যাদেরকে যে পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হল সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিশ্চিত করা। (এক্ষেত্রে দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত করা।)
♦ যাদের মধ্যে যে কাজ দেওয়া হলো, তাদের তত্ত্বাবধান করা, তাদের জন্য দোয়া করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের চেষ্টা করা
♦ নিয়মিতভাবে তাদের নিকট থেকে কাজের প্রতিবেদন নেওয়া
♦ কাজের প্রাপ্ত প্রতিবেদন পরিকল্পনার আলোকে পর্যালোচনা করা
♦ পর্যালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (যেমন কোন একটি থানার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেল উক্ত থানাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে পরিমাণে কাজ করার জন্য দেওয়া হয়েছিল থানাটি তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে, সেক্ষেত্রে এটা ধরা যেতে পারে যে উক্ত থানার জন্য আসলে যতটুকু কাজ বণ্টন করা হয়েছিল উক্ত থানার মধ্যে এর চেয়েও বেশি সক্ষমতা রয়েছে। অতএব তাদের জন্য পরিকল্পনাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। এবং সে মোতাবেক পরিকল্পনা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। অথবা যদি দেখা যায় যত কাজ দেওয়া হয়েছিল তার তুলনায় সম্পাদিত কাজের পরিমাণ অনেক কম হয়েছে তাহলে বুঝা যেতে পারে যে, পরিকল্পনা বণ্টন করার সময় আসলে অতিরিক্ত কাজ তাদেরকে দেওয়া হয়েছে, যা তাদের সামর্থ্যরে অতীত। এক্ষেত্রে তাদের জন্য ব্যবস্থা হবে- সুযোগ থাকলে তাদের পরিকল্পনা কিছুটা কমিয়ে দিয়ে যাদের ক্যাপাসিটি বেশি তাদেরকে সে পরিকল্পনা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়া। অথবা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেল তাদের জন্য বণ্টিত পরিকল্পনার পরিমাণ ঠিক আছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পরিকল্পনা ঠিকমতো বুঝতে পারেননি; তাহলে এক্ষেত্রে তাদের জন্য ব্যবস্থা হবে- তাদেরকে নতুন করে পরিকল্পনা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া। অথবা হতে পারে বণ্টিত পরিকল্পনা ঠিকই বুঝতে পেরেছে কিন্তু তাদের মধ্যে যেই পরিকল্পনা বণ্টন করে দেওয়া সেটার ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ পর্যায়ে ব্যবস্থা হবে- তাদের দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আবার এমনটাও হতে পারে যে তাদের মধ্যে দক্ষতাও আছে কিন্তু ঊর্ধ্বতন শাখার পক্ষ থেকে যে পরিমাণে তত্ত্বাবধান করার কথা ছিল সেই তত্ত্বাবধানের মধ্যে কিছু ঘাটতি রয়ে গিয়েছে; তাহলে তাদের জন্য ব্যবস্থা হবে- তাদেরকে যথাযথভাবে তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা, তাদের জন্য দোয়া করা ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার চেষ্টা করা। এভাবে যদি প্রতিটি স্তর পরিচালনা করা যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ সবাই মিলে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য নিজ নিজ জায়গা হতে ভূমিকা রাখার সুযোগ হতে পারে।)
উক্ত ফর্মুলাটি কেন্দ্র থেকে শুরু করে সমস্ত পর্যায়ের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন ধরি শাখা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে যে বণ্টিত পরিকল্পনা পেয়েছে তারা আবার সেই পরিকল্পনাকে তাদের সেক্রেটারিয়েট ও থানাসমূহের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন এবং পরবর্তী ধাপসমূহ অবলম্বন করবেন।
কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রত্যেকটি স্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মৌলিক কয়েকটি শর্ত এখানে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
এক.
দৃঢ় প্রত্যয় নিতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত না নিলে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হওয়ার কথা নয়। এজন্য কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপশাখা পর্যন্ত সকল স্তরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
দুই.
আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে যে, গৃহীত পরিকল্পনা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব ইনশাআল্লাহ। এ আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য প্রথমেই বিশ্বাস করতে হবে যে, কাজটি করা সম্ভব। আত্মবিশ্বাস সংক্রান্ত একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করছি।
আমাদের অনেকগুলো পরিকল্পনার মধ্যে একটি পরিকল্পনা হচ্ছে ৩:২:১ হারে মানোন্নয়ন অর্থাৎ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই সেশনে প্রত্যেক সদস্য একজন করে সদস্য বৃদ্ধি করবেন, একজন করে সাথী বৃদ্ধি করবেন আর একজন কর্মী বৃদ্ধি করবেন। একজন সাথী- একজন সাথী ও একজন কর্মী বৃদ্ধি করবেন। তেমনিভাবে একজন কর্মী একজন কর্মী বৃদ্ধি করবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য একটি শাখায় যত সদস্য রয়েছে, সে শাখায় ন্যূনতম ততজন সদস্য বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা নেয়া লাগবে। ধরি, একটি শাখায় ১০০ জন সদস্য, ৬০০ জন সাথী আর ৩০০০ জন কর্মী আছে। তাহলে উক্ত শাখার এক বছরে সদস্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া লাগবে ন্যূনতম ১০০ জন, সাথী বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে হবে (১০০+৬০০=) ৭০০ জন, আর কর্মী বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে হবে ন্যূনতম (১০০+৬০০+৩০০০=) ৩৭০০ জন। উক্ত শাখা ১০০ জন সদস্য বৃদ্ধির কথা চিন্তা করলে তাদের কাছে অনেক কঠিন মনে হয়ে যেতে পারে; যার কারণে তারা পরিকল্পনা নেয়ার সময় ১০০ জন সদস্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা না নিয়ে কম পরিকল্পনা নিতে পারেন। তাহলে ৩:২:১ হারে মানোন্নয়নের অনুপাত হিসেবে সারাদেশের অন্যান্য সকল শাখায় সদস্য বৃদ্ধি হলেও উক্ত শাখার কারণে কেন্দ্রের পরিকল্পনা শতভাগ বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব হবে না। তাই অবশ্যই উক্ত শাখাতেও ১০০ জন সদস্য বৃদ্ধির টার্গেট নেয়াটা জরুরি। সেটার জন্য প্রথমেই চাই আত্মবিশ্বাস, আর তার আগে চাই- এটা যে সম্ভব সেটার ব্যাপারে বিশ্বাস করা। বিশ্বাস তৈরির জন্য উক্ত শাখাকে কিছু মোটিভেশন দিতে হবে। বিশ্বাস তৈরির জন্য উক্ত শাখাকে সহজ করে চিন্তা করার কোনো বিকল্প নেই। যেমন উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি, আমরা ১০০ জন সদস্য বৃদ্ধি মোটের উপরে কঠিন মনে হলেও “১ জন সদস্য মাত্র ১ জন সদস্য বৃদ্ধি করবেন” এই কথাটি কঠিন নাও লাগতে পারে। তাও যদি কঠিন লাগে তাহলে আমরা এভাবে দেখতে পারি যে, একজন সদস্য ‘সারাটি বছর ধরে’ মাত্র ১ জন সদস্য বৃদ্ধি করবেন। এটাও যদি কঠিন মনে হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি- একজন সদস্য ‘বারোটি মাস ধরে’ কাজ করে মাত্র ১ জন সদস্য বৃদ্ধি করবেন। সেটাও যদি কঠিন মনে হয়, তাহলে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, একজন সদস্য ‘৩৬৬ দিন (২০২০ সাল লিপ ইয়ার) ধরে’ কাজ করে মাত্র একজন সদস্য বৃদ্ধি করবেন। আবার সেটাও যদি কঠিন মনে হয় তাহলে আমরা ধরতে পারি ‘৬০০ জন সাথী থাকলে সেখান থেকে মাত্র একশত জন সদস্য’ বৃদ্ধি করা হবে অর্থাৎ ‘৬ জন সাথী থাকলে সেখান হতে মাত্র ১ জন’ সদস্য বৃদ্ধি করতে হবে। এখানে উদাহরণস্বরূপ যেই বাক্যসমূহ উল্লেখ করলাম, সবগুলো আসলে একই কথা কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা, সহজ করে দেখার প্রচেষ্টা এখানে বিদ্যমান। সহজ করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করলে যেকোনো বিষয়ে সহজ হয়ে যেতে পারে ইনশাআল্লাহ, বিষয়টা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক। যেভাবে দেখলে আত্মবিশ্বাস অর্জন সহজতর হয় সেভাবেই দেখা প্রয়োজন, তবুও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদেরকে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতেই হবে।
৩:২:১ হারে মানোন্নয়ন বলতে বুঝায়-
♦ ১ জন সদস্য ১ বছরে তথা ১২ মাসে তথা ৩৬৬ দিনে মাত্র ১ জন সদস্য বৃদ্ধি করবেন। তাহলেই ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সদস্য বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হবে ইনশা-আল্লাহ।
♦ প্রতিজন সদস্য ও সাথী ১ বছরে তথা ১২ মাসে তথা ৩৬৬ দিনে মাত্র ১ জন সাথী বৃদ্ধি করবেন। তাহলেই ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সাথী বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হবে ইনশাআল্লাহ।
♦ প্রতিজন সদস্য, সাথী ও কর্মী ১ বছরে তথা ১২ মাসে তথা ৩৬৬ দিনে মাত্র ১ জন কর্মী বৃদ্ধি করবেন। তাহলেই ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে কর্মী বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন হবে ইনশাআল্লাহ।
তিন.
আল্লাহর ওপর ভরসা করে সকলকে সাথে নিয়ে কাজে নেমে যাওয়া। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন কাজই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে চেয়ে পথ চলতে হবে। চেষ্টা করলে আল্লাহ তায়ালা সাধারণত তার প্রতিদান দেন। কিন্তু ফলাফল পাওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজে নেমে যেতে হবে।
এরপর আসি অনেক সময় মনে হতে পারে পরিকল্পনার মধ্যে লিপিবদ্ধ এতো এতো কাজ কিভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে! সেক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা হয়তোবা অনেক কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজের বিরাট একটি অংশের কাছে পৌঁছতে পেরেছি কিন্তু এখনো প্রচুর ছাত্র দ্বীনের সঠিক দাওয়াত পায়নি। তাদের কাছে আমাদের যেতেই হবে। সেজন্য মোট কাজের পরিমাণ কমানোর সুযোগ আমাদের আসলে নেই, বরং বাড়াতে হবে। তবে, ব্যক্তির উপরে চাপ বাড়ানো যাবে না। সেক্ষেত্রে একটু পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে আমাদের যে সংখ্যক জনশক্তি রয়েছে তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে পারলে ইনশাআল্লাহ খুব সহজেই আমাদের পরিকল্পনার আলোকে কাজ বাস্তবায়ন সম্ভবপর হতে পারে বরং আরও অনেক বেশি কাজ করা সম্ভব। কিভাবে ব্যক্তির ওপর কাজ কমিয়ে মোট কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়, সে ব্যাপারেই এখন আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
প্রথমত আমাদেরকে কার্যকরী পরিকল্পনা (এক্সিকিউটিভ প্ল্যান/অ্যাকশন প্ল্যান) করে নিতে হবে। এর মাধ্যমে পুরো পরিকল্পনাটি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে পরিণত হবে এবং সেই অংশগুলো সংশ্লিষ্ট জনশক্তিদের মধ্যে বণ্টন করে দিলে যেকোন মানের কর্মী তাদের জন্য নির্ধারিত কাজগুলো সহজে বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং গোটা বছর ধরে ধীরে-সুস্থে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। এক্সিকিউটিভ প্ল্যান করার জন্য তিনটি প্রশ্ন আমাদেরকে করতে হবে।
♦ প্রথমত একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য
কী কী কাজ করা হবে
♦ দ্বিতীয়ত কে বা কারা কোন কাজটি করবে
♦ তৃতীয়ত কখন কোন কাজটি করা হবে।
যেকোন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে পারলে আমাদের পক্ষে কার্যকরী পরিকল্পনা বা এক্সিকিউটিভ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভবপর হতে পারে। এক্সিকিউটিভ পরিকল্পনার দুইটি উদাহরণ দেখি এখানে।
সংগঠনের কাজের জন্য সকল জনশক্তিকে যার যার সামর্থ্যরে আলোকে কাজে লাগানো জরুরি। সকলকে কাজে লাগাতে পারলে মোট কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে কিন্তু ব্যক্তির উপরে প্রেসার কমে যাবে। একইসাথে সকল জনশক্তিকে গড়ে তোলাটাও সম্ভব হবে। সে জন্য, খেয়াল রাখতে হবে, কোন জনশক্তিকে এতো বেশি কাজ দেওয়া উচিত হবে না, যা তার ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। আবার কোন জনশক্তি কাজ করতে কম আগ্রহ দেখায় বিধায় তাদেরকে একবারে কাজ দেয়া বন্ধ করা উচিত হবে না, বরং কিছু কিছু করে কাজ দেয়ার মধ্য দিয়ে তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত হবে।
কম সক্রিয় জনশক্তিদেরকে সক্রিয় করা এবং যারা সক্রিয় রয়েছেন, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে সবাই মিলে অনেক বেশি কাজ করা সম্ভব এবং তাদের সবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সমাজের সকল ছাত্রের নিকট দাওয়াত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হতে পারে, ইনশাআল্লাহ।
নিজ নিজ স্তরের জনশক্তিদের জন্য দোয়া ও তাদেরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা চাইলে সবাই মিলে তাহলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় আবদ্ধ থেকে দ্বীনি আন্দোলনের কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভবপর হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন।
লেখক : সংগঠক ও পরিকল্পনাবিদ
মন্তব্য