চলুন, ডেকে ফিরি…

ঘুরতে গিয়েছিলাম একটি ছোট্ট নদীর ধারে, এটাকে খাল বা লেক বললেও ভুল হবে না। বিকেলের গোধূলিতে হাঁটছিলাম সে লেকের পাড় দিয়ে। মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে গেছে। মসজিদ খোঁজার চেষ্টা করলাম আশেপাশে। কিন্তু কাছাকাছি মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেল না। বাঁশের সাঁকো দিয়ে খাল পার হয়ে একটি স্কুল পেলাম। সেখানে ওয়াশরুমের দেখা মিলল। পুরাতন স্কুল, কিন্তু পাশে নতুন বিল্ডিং বানানো হয়েছে। তাই আধুনিক সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। সেখানে অযু করে নিলাম। অযু শেষে এবার নামাজ পড়ার জন্য একটু সুবিধাজনক স্থান খুঁজতে যাব, এমন সময় খেয়াল করলাম- স্কুলের পুরাতন বিল্ডিং-এর পাশে একটি কুঁড়ে ঘর। কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। সেই ছোট্ট ঘরের মধ্যে একজন ব্যক্তিকে নামাজের সিজদায় যেতে দেখলাম। মনটা আবেগাপ্লুত হল। ঠিক সেই মুহুর্তে কী মনে পড়েছিল, জানেন! মনে পড়েছিল- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। সেই মক্কায় যে দাওয়াতের সূচনা করেছিলেন তিনি (সা); সেই দাওয়াত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এদেশে এসেছে। তখন থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পরে নামাজের সময় হওয়ার পরপর একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে আল্লাহর পানে নামাজে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন একজন মানুষ। আর আমরা দুইজন ভাই নামাজের জন্য ব্যাকুল হয়েছি। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আল্লাহর পানে ধরণা দিতে প্রস্তুত হচ্ছি আমরা। এই যে দ্বীনের বার্তা সুদূর মক্কা থেকে এই বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে কীভাবে পৌঁছেছে? আর সে বার্তা আজও জারি আছে কীভাবে? কোন মাধ্যম এখানে কাজ করেছে? সহজ উত্তর- দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ (সা) নির্দেশ দিয়েছিলেন, “একটি আয়াতও আমার নিকট থেকে শুনে থাকলে তা অন্যের নিকট পৌঁছে দাও।”(সহীহুল বুখারী) সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের দৃঢ় দায়িত্বানুভূতিই দ্বীনের বার্তা দিকে দিকে প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে মুমিনদের। সে নির্দেশ আজও আছে আমাদের প্রতি, যারা আমরা মুমিন- মুসলিম। রাসূলের (সা) সে নির্দেশ আজও কানে বাজতে হবে আমাদের। দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে, প্রান্ত থেকে প্রান্তে; যুগ থেকে যুগান্তরে; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
দ্বীনের দাওয়াতের জন্য আল্লাহ আদেশ করেছেন আমাদেরকে। তিনি মানুষকে তাঁর পথের দিকে আহ্বান করতে বলেছেন বুদ্ধিমত্তার সাথে; হিকমতের সাথে তথা এমন পন্থায় যেন তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। হিকমতপূর্ণ যে পন্থায় আল্লাহ দাওয়াতি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন তা সকল সময়ে; সকল পরিস্থিতিতে; সকল পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। হিকমতপূর্ণ পন্থায় দাওয়াতি কাজের অংশ হিসেবে আমাদেরকে ভাষা ব্যবহার করতে হবে কোমল; হৃদয়গ্রাহী। আর দাওয়াত দিতে হবে ‘মাওয়িযায়ে হাসানাহ’র পন্থায়। ‘মাওয়িযায়ে হাসানাহ’র দাবি হচ্ছে, শুধুমাত্র বাহ্যিক শব্দের মাধ্যমে দাওয়াত প্রদান নয়; বরং মুখের ভাষার পাশাপাশি হৃদয়ের ভাষা দিয়েও আহ্বান করা। শুধুমাত্র যুক্তির মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের বা প্রকাশের প্রয়াস নয়; বরং যার কাছে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে তার বিবেক ও চেতনাকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে তার নিকট দাওয়াত পৌঁছানো। দায়ী মমত্ববোধ সহকারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে এমনভাবে দাওয়াতের বার্তা পৌঁছাবেন যেন দায়ীর ভাষা শুধুমাত্র ব্যক্তির কানের পর্দায় সঞ্চারিত না হয়; বরং কানের পর্দায় দাওয়াতের বাণী পৌঁছানোর সাথে সাথে তা যেন ব্যক্তির হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়ে মনের গভীরে গিয়ে আলতো করে নাড়া দিয়ে বলে, “এসো ভাই, এসো আল্লাহর পথে চলি। এ পথে কল্যাণ রয়েছে; রয়েছে শান্তি; রয়েছে মুক্তি। এ পথ মেনে নিলে তুমি পাবে সফলতা। এসো ভাই, এসো আল্লাহর পথে।”

“তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যিনি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে, নিজে আমলে সালেহ করে এবং বলে, আমি একজন মুসলমান।”
সূরা হামিম সাজদাহ : ৩৩

দাওয়াতি কাজ করা আমাদের ঈমানেরই দাবি। আমাদের ঈমান যত শক্তিশালী হবে, আমরা মানুষের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য তত বেশি ব্যাকুল হওয়ার কথা। একটি উদাহরণ দেই- ধরুন, আপনার আদরের ছোট্ট ভাগনের বয়স ১০ মাস। হামাগুড়ি দিয়ে চলে। ও হাতের কাছে যা আছে, তা নিয়েই খেলছে। কাছেই একটা মোমবাতি জ্বালানো আছে। খেলতে খেলতে মোমবাতিতে প্রজ্বলিত লাল রঙের আগুনটা ধরার জন্য ও হাত বাড়ালো। বলুন তো, আপনি এটা দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারবেন? চুপচাপ বসে বসে ওকে আগুনে হাত দেয়াকে সজ্ঞানে সমর্থন করতে পারবেন? অবশ্যই পারবেন না। কেউই পারবে না।পারা সম্ভব নয়। কারণ, আপনি বিশ্বাস করেন যে, ও আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে; কষ্ট পাবে। আগুন এমনই; পুড়িয়ে দেয়।তাহলে! আমাদের আশেপাশের যারা জেনে অথবা না জেনে ইসলামকে অমান্য করে অসহনীয় অবর্ণনীয় কষ্টের লেলিহান শিখার (জাহান্নামের) দিকে পা বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাদের না থামিয়ে কি আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি? দ্বীনের পথে তাদের আহ্বান না করে; না বুঝিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? সম্ভব না। কারণ, আমরা পরকালে খুব দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। দ্বীনের দাওয়াত দানে তৎপর থাকা যে আমাদের ঈমানেরই দাবি। রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীন বিজয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত সহকারে ও দ্বীনে হক্ব সহকারে, যাতে করে তিনি এই দ্বীনে হক্বকে অন্য সকল মতবাদের উপরে বিজয়ী করতে পারেন, এতে করে মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন!” (সূরা সফ: ০৯)
দ্বীন বিজয়ের সে কাজ করতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াতি কাজ করেছেন। নবুওয়্যাত পাওয়ার কয়েকদিনের মাথায় আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবীজিকে (সা) আহ্বান করলেন, “হে কম্বলাবৃত ব্যক্তি! উঠে পড়ুন। ভীতি প্রদর্শন করুন এবং আপনার রবের মহানত্বের ঘোষণা দিন।” (সূরা মুদ্দাচ্ছির: ১-৩) রাসূলুল্লাহ (সা) আজীবন সে নির্দেশ পালন করেছেন, তিনি ক্লান্ত হননি; পরিশ্রান্ত হননি; এ কাজ থেকে ক্ষান্ত হননি। তিনি মিশন হিসেবেই দাওয়াতি কাজকে পালন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী বানিয়ে, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে?” রাসূলুল্লাহর (সা) উম্মত হিসেবে দ্বীন বিজয়ের সে কাজ আমাদেরকে করতে হয়। আর সেকারণেই কাজের সর্বপ্রথম অংশ হিসেবে দাওয়াতি কাজে আমাদেরকে ব্যাপৃত হতে হয়।
‘দায়ী’ মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে। তাঁরা কথার মাধ্যমে ডাকে; লেখনীর মাধ্যমে ডাকে; নানা উপায়ে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে ডাকে। কিন্তু ততটুকুতেই দায়ীর কাজ শেষ হয় না। যে দ্বীন মানার জন্য ‘দায়ী’ অন্যকে ডাকেন, সর্বপ্রথম দায়ীর কাজ হচ্ছে নিজে সে দ্বীন মেনে চলা, দ্বীনের নির্দেশ অনুসারে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করা, নেক কাজ করা তথা আমলে সালেহ করা। আর নিজের দ্বীন মেনে নেয়ার ঘোষণা শোনানো তথা ‘নিজে যে একজন মুসলিম’ তাত বলা। ‘দায়ী’ এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায় এবং আল্লাহর রহমত পেলে তাতে বরকত পাওয়া যায়। একটা কমন তত্ত্ব আছে-‘ভোক্তার বিজ্ঞাপনই সেরা বিজ্ঞাপন’। যেমন, কেউ কোন ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে যদি বেশ উপকার পান এবং সে উপকার পাওয়ার কথা কোন জটিল রোগীর নিকট জানান, তাহলে সে রোগী ঐ ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি আগ্রহী হোন, যতটা না আগ্রহী হোন বিলবোর্ডে ডাক্তারের গুণগান লিখা দেখে। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন হতে পারে যে, যিনি দায়ী তিনি মানুষকে যে পথে আহ্বান করছেন, সবার আগে নিজে সে পথ অবলম্বন করে এবং পূর্ণরূপে এপথের অনুসরণ করে নিজেকে আত্মসমর্পণকারী বান্দা তথা মুসলিমে পরিণত করে আর মুসলিম হিসেবে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে মানুষকে এই কথা জানায় যে, আমি মুসলিম, আমি দ্বীনের এ পথ অবলম্বন করে নিজে শান্তি পেয়েছি, সাফল্যের পথ পেয়েছি, পেয়েছি মুক্তির পথ। আপনিও আসুন; তাহলে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি উদ্বুদ্ধ হতে পারেন, ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ বলেছেন“তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যিনি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে, নিজে আমলে সালেহ করে এবং বলে, আমি একজন মুসলমান।” (সূরা হামিম সাজদাহ: ৩৩)
মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকে ফেরা তথা মানুষের মাঝে দাওয়াতি কাজ করা তাই আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। সকল মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানের পাশাপাশি আমাদেরকে বিশেষভাবে শিশু-কিশোরদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করা জরুরি। কারণ আজকের শিশু-কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যত, দেশ গড়ার কারিগর। এখন থেকে ২০-৩০ বছর পরে আজকের কিশোররাই এদেশকে পরিচালনা করবে। তাই ৩০ বছরের পরের বাংলাদেশ যেমন দেখতে চাই, এখন থেকে তেমন কারিগরই গড়তে হবে। আজকে তুলিতে যে রঙ লাগাবেন, ক্যানভাসে সে কালি লাগবে ত্রিশ বছর পরে। তাই ক্যানভাসে স্বপ্নের রঙের আদলেই তুলি রাঙাতে হয়। দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোরদের তাই আজ বাস্তবিক অর্থে স্বপ্ন দেখার পালা, সকল পর্যায়ের মানুষের পাশাপাশি যাদের মূল দৃষ্টি থাকা উচিত আজকের নতুন প্রজন্ম, কিশোর প্রজন্ম।
আজকের কিশোররাই আগামী দিনের নাগরিক। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচালকের আসনে স্থান হবে তাদেরই। যারা মানব সমাজে বড় বড় স্বপ্ন দেখাবে আগামী দিনে, তারাই আজ নিজেরা স্বপ্নের বীজ বুনছে মনের যমীনে। বীজতলায় স্বপ্নের বীজ বুনে সেখান থেকে উদ্গীরিত চারাকে পরিচর্যা করতে শুরু করবে অচিরেই। এ কিশোরদের স্বপ্ন বোনার সময় আমরা যদি সঠিক বীজটা বাছাই করে দিই এবং সদ্য উদগিরিত চারাকে নিড়ানি দেয়ার সময় মালী হিসেবে যত্ন নিতে পারি যথার্থভাবে, তবে আগামীর বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ও ফলদায়ীবৃক্ষ আমরা ঠিকভাবেই পাব, ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে চাই, একাগ্রচিত্তে নিবেদিত প্রাণে আন্তরিক মালীর আদলে নিজেদের প্রকাশ।

মন্তব্য