সূরা ফাতিহার মধ্য দিয়ে আমরা নিমিষেই ঘুরে আসতে পারি যতদূর যাওয়া সম্ভব, সুবহানাল্লাহ। সমস্ত প্রকার অবদানের চূড়ান্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার হক একমাত্র আল্লাহর, সে স্বীকৃতি দিয়ে শুরু হয় এ পরিভ্রমণের যাত্রা। কারণ এই ‘আ’লামীন’-এর প্রতিপালক তিনি। আ’লামীন খেয়াল করতে করতে আমরা পুরো বিশ্ব পরিভ্রমণ করি যেমনি, তেমনি ইতিহাসের সব পরতে পরতেও আমাদের মনের বিচরণ হয়ে যায়। কারণ, আ’লামীন বলতে বিশ্বজাহান, মহাবিশ্বকে বুঝায়, আবার পৃথিবীতে যতসব জাতির পরে জাতি এসেছে, সেসকল জাতির কথাও বুঝায়। “আররহমানির রহীম” বলে দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের মহান রবের করুণার কথা স্মরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতকে পাশাপাশি দেখে ফেলি একবার, এক নজরে। কেননা, দুনিয়াতে তাঁর দয়ার গুণ বুঝাতে রহমান আর আখিরাতে তাঁর দয়ার গুণ বুঝাতে রহীম শব্দ ব্যবহৃত। তাঁর স্নেহময়, মায়াময়, দয়াশীল সত্তার কথা হৃদয়ের মধ্যে অনুরণন হতে হতে চূড়ান্ত বিচারের দিনের যে চিত্র, তাও উপলব্ধি করি একবার; সেখানে আমাদের অসহায়ত্ব আর আল্লাহ তায়ালার সুনিপুণ বিচার-ব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে হৃদয়পটে।
সেদিনের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কারও কোন কিছু করার থাকবে না, সে কথা স্মরণ করে নিই মুহূর্তের মধ্যে। বিচার দিবসের এই দিনের “ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি” ধ্বনি মনের মধ্যে ধ্বনিত হতে হতে আমরা বিচারের জন্য এই দুনিয়ার কর্মক্ষেত্রের কথা স্মরণ করি, ফিরে আসি দুনিয়ার ঘটমান-চলমান অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের জীবনের ভাবনায়; আত্মসমালোচনায় লেগে যাই নিজের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে। কেননা এখানের কাজের বিচারইতো সেদিন হবে। আর সে বিচারে পার পেতে চাইলে প্রকৃত সত্য, আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা তথা নিয়মকানুন তথা দ্বীন মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। তখন একমাত্র আল্লাহর উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতের স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি প্রদান করি- “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়াইয়্যাকা নাসতায়ীন” উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। সমস্ত কার্যক্রমও আল্লাহর জন্যই নিবেদিত বলে ঘোষণা করি আবার চাওয়া-পাওয়ার জায়গাতেও তাঁকেই দেখি; সাক্ষ্য দেই- তাঁর জন্যই সব করি ও করব, তাঁর কাছেই সদা চাই ও চেয়ে যাবো। আল্লাহর প্রতি এই স্বীকৃতি দিয়ে এই স্বীকৃতি মোতাবেক চলতে পারার জন্য আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই। কেননা সাহায্য করার ইখতিয়ারও তো শুধুমাত্র তাঁরই। মহামহিম আল্লাহর সাহায্য ছাড়া যে এ সঠিক পথে অটল থাকা সম্ভব নয়, সে অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে চাই, তিনি যেন আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, সঠিক পথে অটল রাখেন, সঠিক পথে পরিচালনা করেন।
আবার এই চলার পথ যে শুধুমাত্র থিওরিটিক্যাল নয়, বরং প্র্যাকটিক্যালও- সে কথা মুহূর্তের মধ্যে মনে এসে যায়। এ সাক্ষ্য পালনের পদ্ধতি শেখানোর জন্য আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ) পর্যন্ত নবী রাসূলগণকে আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছিলেন যুগে যুগে; তাঁরাই যে আমাদের পথপ্রদর্শক, সেটার সাক্ষ্য দিতেও মোটেই দেরি করি না। নবী-রাসূলদের এই ইতিহাসও পরিভ্রমণ করি এ ক্ষণে। নবী রাসূলগণের শেখানো সে পন্থায় বিভিন্ন সময় শুহাদা, সলেহীন তথা আল্লাহর নেককার বান্দারাও চেষ্টা করেছেন, আমরাও যেন তাদের দলে শামিল হতে পারি ও থাকতে পারি, সে প্রত্যাশা মনের আকুতিতে ভেসে ওঠে। তাদের মধ্যে আমরা আমাদের নিজেদেরকে দেখতে চেষ্টা করি। আল্লাহর প্রিয়তম বান্দাদের দলে শামিল হওয়ার এ এক অভূতপূর্ব আকুতি ফুটে ওঠে “সিরত্বল্লাযীনা আনয়া’মতা আলাইহিম” বাক্যের উচ্চারণে। এ পথ মুক্তির পথ, এ পথ জান্নাতের পথ। এ পথে চললে পৃথিবীর শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সত্যপথের পথিকদের সুবিশাল আলোকিত দলে নিজেকে শামিল করতে পারব, সেটা ভেবেই আনন্দিত হই, হই পুলকিত।
পরক্ষণেই ভয় হয়, শঙ্কা এসে মনে ভিড় করে, এ পথে অটল থাকতে পারবো তো জীবনের শেষ পর্যন্ত এ পথে অটল থাকতে পারলেই তো কেবল সাফল্য। সেটা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই বিচ্যুত হওয়া থেকে। এমন কোন কাজ যেন করে না ফেলি, যেটার কারণে আল্লাহর অসন্তুষ্টি পেতে হয়। বিভিন্ন সময়ে মানুষেরা আল্লাহর নাফরমানী করে আল্লাহর গজবের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, হয়েছে পথভ্রষ্ট। সেসব জাতির কথা স্মরণ করে ঘুরে দেখি নানান সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলো। সেই সব মানুষদের পথে যেন আমরা না চলি, সেইসব পথভ্রষ্টদের দলে যেন শামিল না হই, সেজন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দয়া চাই-“গাইরিল মাগদ্বুবী ’আলাইহিম ওয়ালাদ্দ্বল্লীন” বলে।
মাত্র সাতটি বাক্যের মধ্য দিয়ে এই সুবিশাল পরিভ্রমণ সম্পন্ন হয় সূরা ফাতিহা তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। এবং এই পরিভ্রমণ আমাদেরকে প্রতি নামাজের প্রতি রাকায়াতে বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয়। মুখে উচ্চারণের সাথে সাথে মনের সংযোগ নিশ্চিত করতে পারলে, সে পরিভ্রমণ কতইনা চমৎকার, কতইনা অসাধারণ, কতইনা উপভোগ্য! সুবহানাল্লাহ।
মন্তব্য